২২ অক্টোবর, ২০২০:
ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা ও দেশজ জ্বালানির অপ্রতুলতা বিবেচনায় রেখে পরিবেশবান্ধব এবং আর্থিকভাবে লাভজনক দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে পাবনার রূপপুরে। রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ভারী যন্ত্রাংশ নির্মাণ করা হচ্ছে। নির্মাণ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি তদারকির জন্য রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশেররাষ্ট্রদূত কামরুল আহসান সেইন্ট-পিটার্সবার্গ, পেট্রোজাভোদস্ক এবং ভলগাদনস্ক এ অবস্থিতবিভিন্নকারখানা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন।
সেইন্ট-পিটার্সবার্গে অবস্থিত পাওয়ার মেশিন গ্রুপের চারটিকারখানায় উৎপন্ন হচ্ছেরূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। পাওয়ার মেশিন কোম্পানিরতাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যটারবাইন ও জেনারেটর, পরিবহন এবং সমূদ্রগামী জাহাজের যন্ত্রাংশ এবং ট্রান্সফরমারসহবিভিন্ন বৃহত যন্ত্রপাতিরনকশা প্রণয়ন এবং উৎপাদনে ১৬০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। পৃথিবীর ৫৭টি দেশে পাওয়ারমেশিন কোম্পানির উৎপাদিত যন্ত্রাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে।পারমাণবিক শক্তি বিভাগের প্রধান ও উপ-প্রধাননির্বাহী কর্মকর্তামি. এনটন ভিক্টরভ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নির্মাণাধীন যন্ত্রপাতি নির্মাণ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি বর্ণনা করেন।
পাওয়ার মেশিন গ্রুপের এল এমজেড কারখানাটি রাশিয়ার বৃহত্তম টারবাইন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে এল এম জেড কারখানায় রূপপুরপারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের টারবাইনের জন্য নির্মাণাধীন হাইপ্রেশার রোটর এবং চারটি লো-প্রেশার রোটর এর নির্মাণ প্রক্রিয়া দেখানো হয়। হাইপ্রেশার রোটরের নির্মাণ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। পাওয়ার মেশিনের টুরবা এটমগ্যাজকারখানায় উৎপন্ন হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটেরটারবাইনের জন্য হাই প্রেশার সিলিন্ডার, লো-প্রেশার সিলিন্ডার, কন্ডেন্সার সেট, লো-প্রেসার হিটার এবং আরোকিছু যন্ত্রপাতি। ইলেক্ট্রসিলাকারখানায় তৈরী হচ্ছে জেনারেটর এবং পাওয়ার ম্যাশিন-টোশিবা কারখানায় প্রস্তুত হচ্ছেট্রান্সফরমার।কারখানাটির কর্মকর্তারাজানাননির্ধারিত সময়ে ও নির্বিঘ্নে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি নির্মাণ কাজ সম্পন্নের জন্য কারখানার উৎপাদন শাখার উপ-প্রধানেরনেতৃত্বে গঠিত বিশেষ ওয়ার্কিং গ্রুপ নিয়মিত কাজ করছে। এসময় রাষ্ট্রদূত কামরুলআহসান বলেন নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প সম্পন্ন করা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
পেট্রোজাভোদস্কমাশ কারখানাটি পেট্রোজাভোদস্ক শহরেঅবস্থিতরোসাটম এর কারিগরী বিভাগ এ্যটম-এনার্গোম্যাশ এর অধীনস্থ একটি প্রতিষ্ঠান। শাখার পরিচালক পাভেল মারচেঙ্কো রাষ্ট্রদূত কামরুলআহসানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানান।পেট্রোজাভোদস্কমাশ কারখানা পরিদর্শনের শুরুতে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক পাভেল মারচেঙ্কোকারখানার অতীত এবং বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত জনাব কামরুল আহসানকে অবহিত করেন এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নির্মাণাধীন যন্ত্রপাতি নির্মাণ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি বর্ণনা করেন। পরিচালক বলেন সর্বোচ্চ গুণগত মান বজায় রেখে নির্ধারিত সময়ে বাংলাদেশের জন্য যন্ত্রপাতি নির্মাণ সম্পন্ন করা তাঁদের জন্য সম্মানের এবং এটি তাঁদের মহান দায়িত্বও।
পেট্রোজাভোদস্কমাশ কারখানাটি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের জন্য চারটি রিয়্যাক্টর কুলান্ট পাম্পের স্ফেরিক্যাল হাউজিং ও স্পেসার, দ্বিতীয় ইউনিটের চারটি স্ফেরিক্যাল হাউজিং ও স্পেসার, প্রথম ইউনিটের প্রাইমারি সার্কিট পাইপলাইন, দ্বিতীয় ইউনিটের আটটি প্যাসিভ কোর ফ্লাডিং সিস্টেম এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে। কারখানাটি থেকে ইতোমধ্যে প্রথম ইউনিটের রিয়্যাক্টর কুলান্ট পাম্পের একটি স্ফেরিক্যাল হাউজিং রূপপুরে সরবরাহের জন্য সমূদ্র বন্দরে প্রেরণ করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় স্ফেরিক্যাল হাউজিং এর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। রিয়্যাক্টর কুলান্ট পাম্প একটি সেফটি ক্লাস-১ ইকুইপমেন্ট এটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রিয়্যাক্টর এবং স্টিম জেনারেটরের মধ্যে কুলান্ট প্রবাহ নিশ্চিত করে। প্রতিটি স্ফেরিক্যাল হাউজিং এর উচ্চতা ৩.৫ মিটার, প্রস্থ ৩ মিটার এবং ভর ৩৩ টন। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপদ পরিচালনার লক্ষ্যে আল্ট্রাসনিক টেস্ট, রেডিওগ্রাফিক টেস্ট, হাইড্রলিক টেস্ট ও অন্যান্যনন-ডেস্ট্রাক্টিভ ও ডেস্ট্রাক্টিভ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি যন্ত্রের নির্ভরযোগ্যতা ও স্ট্রেন্থ নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করা হয়।
এ্যটম-এনার্গোম্যাশ এর ভোলগোদোনস্ক শাখা এটোমম্যাশকারখানাটিপারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিউক্লিয়ার আইল্যান্ডের ভেসেল এবং হিট-এক্সচেঞ্জ যন্ত্রপাতি তৈরীর শীর্ষস্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা যেটি ১৯৭৬ স্থাপিত। এটোমম্যাশ কারখানা পরিদর্শনের শুরুতে রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ইগর ভি কতভ নির্মাণ কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করেন। সভায়বাংলাদেশের জনগণের জন্য গৌরবজনক এই প্রকল্পটির কাজ গুণগত মান বজায় রেখে নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করা হবে বলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আশা প্রকাশ করেন। সভা শেষে কারখানাটির বিভিন্ন বিভাগে রূপপুর প্রকল্পের জন্য নির্মাণাধীন যন্ত্রাংশ পরিদর্শন করা হয়।
ভোলগোদোনস্ক এর এটোমম্যাশ কারখানায় রূপপুর পারমাণবিকবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র পারমাণবিক চুল্লী এবং স্টিমজেনারেটরসহ প্রটেকটিভ টিউব ইউনিট, কোর ব্যরেল এবং কোর ব্যফেল নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। প্রথম ইউনিটের পারমাণবিক চুল্লী এবং চারটি স্টিম জেনারেটরনির্ধারিত সময়ে প্রস্তুত করে রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে প্রেরণ করা হয়েছে। নির্মাণাধীনঅন্যান্য যন্ত্রাংশ নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করা হবে।কারখায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেরযন্ত্রাংশের নির্মাণকাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করে রাষ্ট্রদূত সন্তোষ প্রকাশ করেন।
কারখানাগুলিপরিদর্শনকালেবাংলাদেশ দূতাবাসমস্কোর নিউক্লিয়ার পাইয়ার উইং এর কাউন্সেলর এবংকারখানাগুলিতে নিয়োজিত বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের পরিদর্শকরাও উপস্থিত ছিলেন।
পরিদর্শনকালে কারখানাগুলির উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ এবং প্রকল্পেরজেনারেল কন্ট্রাক্টর জেএসসি অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্টের প্রতিনিধি রূপপুর প্রকল্পেরসার্বিক ব্যবস্থাপনা এবং অগ্রগতি তদারকির জন্য রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে বাংলাদেশেরবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী জনাব ইয়াফেস ওসমানকে আন্তরিকধন্যবাদ জানান।
রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসান বলেন বাংলাদেশ-রাশিয়ারসম্পর্ক ঐতিহাসিক।বাংলাদেশেরমহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা স্মরণ করে রাষ্ট্রদূতআশা প্রকাশ করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতির পিতাবঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পবাস্তবায়নের মাধ্যমে দুইদেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে।