প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,
আজকের এই সংবাদ সম্মেলনে আপনাদের সবাইকে স্বাগতম। আজ আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস। এ দিবসে আপনাদের সবাইকে অভিনন্দন।
০২। আপনারা জানেন যে, গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখ থেকেজাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৫-তম অধিবেশন নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘ সদরদপ্তরে শুরু হয়েছে। এই অধিবেশনের উচ্চ পর্যায়ের বিতর্কপর্ব আগামী ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখথেকে অনুষ্ঠিত হবে। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রকোপের কারণে এবারের অধিবেশন পূর্ববর্তী বছরগুলো থেকে একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য বিধিমালাঅনুসরণ করে জাতিসংঘের ইতিহাসে এই প্রথম ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সদস্য রাষ্ট্রসমূহ নিজ নিজ দেশ থেকে এবারের সভায় অংশগ্রহণ করবেন।
০৩। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম ও পূর্বধারণকৃত বক্তব্যের মাধ্যমে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৫-তমঅধিবেশনে অংশগ্রহণ করবেন। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে আমি ও মাননীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বেশ কিছু সভায় অংশগ্রহণ করতে পারি।
০৪। এ বছর সাধারণ বিতর্কের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছেঃ“The future we want, the United Nations we need: reaffirming our collective commitment tomultilateralism ∑ confronting COVID-19 through effective multilateral action”।মূলত, ২০২০ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পূর্তি ও মহামারী কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবকে উপজীব্য করে এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এবারের অধিবেশনটি বেশ কিছু কারণে তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রথমতঃ এবছর জাতিসংঘের ৭৫ বছর পূর্তি। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পূর্তিতে অনুষ্ঠিতব্য এই অধিবেশন যেমনবর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বহুপাক্ষিকতাবাদের প্রাসঙ্গিকতাকে সামনে নিয়ে আসবে তেমনি বিশ্ব নেতৃবৃন্দ আগামী বছরগুলোতে কি ধরনের জাতিসংঘ দেখতে চান সে বিষয়ে তাঁদের অভিমত, চিন্তাধারা ও পরিকল্পনা তুলে ধরবেন।
দ্বিতীয়তঃ কোভিড-১৯ মহামারী দমনে রাষ্ট্রসমূহের সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টিও এবারের অন্যতম আলোচিত বিষয় হিসেবে গণ্য হচ্ছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ দমনে রাষ্ট্রসমূহের উদ্যোগ, কোভিড-১৯ এর ফলে সৃষ্ট অসমতা, স্বল্পোন্নত ও অভিবাসী প্রেরণকারী দেশ সমূহের উপর এর দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাবও অর্থনৈতিক বিপর্যয়সহ নানবিধ সমস্যা মোকাবেলা এবং কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়সমূহ নিয়ে এবারের অধিবেশনে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
তৃতীয়তঃ মহামারী প্রতিরোধের উপর গুরুত্বারোপ করার কারণে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন প্রচেষ্টা যাতে ব্যহত না হয় এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন ও কোভিড-১৯ দমন যাতে সমান গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়এবং গ্রাজুয়েটিং দেশগুলোর গ্রাজুয়েশন প্রক্রিয়াকে টেকসই করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষ করে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তার বিষয়সমূহও এবারের অধিবেশনে উঠে আসবে।
চতুর্থতঃপ্রতিবারের মতএবারও জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যাটি তুলে ধরবে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আইসিজেতে চলমান মামলা এবং আইসিসিতে রোহিঙ্গা নির্যাতনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে চলমান আইনি প্রক্রিয়ার কারণে এবারের অধিবেশনে রোহিঙ্গা সমস্যা পূর্বের বছরগুলোর মতইগুরুত্বসহকারে আলোচিত হবে।
পঞ্চমতঃ এ বছর, ১৯৯৫ সালে বেইজিং এ অনুষ্ঠিত World Conference on Women-এর ২৫ বছর পূর্তি। এ প্রেক্ষিতে এবারের অধিবেশনে নারীর ক্ষমতায়ণ, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধের মত বিষয়সমূহ ব্যপকভাবে আলোচিত হবে।
০৫। এবারের অধিবেশনচলাকালে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীজাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্ক পর্বে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রাখবেন।প্রতিবারের মত এবারও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলায় বক্তৃতা দেবেন। বক্তৃতায় স্বাভাবিকভাবেই কোভিড-১৯ দমনে বিশ্ববাসীর সম্মিলিত প্রচেষ্টার আবশ্যকতা, ভ্যাক্সিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ, এবং জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত ও দুর্দশা দমনে আমাদের গৃহীত কার্যক্রম প্রাধান্য পাবে। পাশাপাশি, জলবায়ূ পরিবর্তন, প্রযুক্তির আদান প্রদান, অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ, লিঙ্গ সমতা নিশ্চিতকরণ, শিশু স্বাস্থ্য ও তাদের অধিকার, শান্তিরক্ষা ও শান্তি বিনির্মাণ, এবং নারীর ক্ষমতায়ণের মতো বিষয়সমূহউঠে আসবে। তাছাড়া, প্রতিবারের মত রোহিঙ্গা সমস্যা ও তাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রাধান্য পাবে।
০৬। সাধারন বিতর্ক পর্বের পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে সব গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ পর্যায়ের সভায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবেন সেগুলো হলোঃ
এক. জাতিসংঘের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যেআজ ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য “High Level Event to Mark the 75th Anniversary of United Nations”শীর্ষক সভা।এই অনুষ্ঠানটির মধ্য দিয়েই এবারের অধিবেশনের High Levelপর্ব শুরু হতে যাচ্ছে। কোভিড মহামারীর প্রেক্ষাপটে এই সভার মূল প্রতিপাদ্য “The future we want, the United Nations we need: reaffirming our collective commitment tomultilateralism”যা এবারের সাধারণ বিতর্কপর্বসহ সকল সভার আলোচ্য বিষয়ের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে।
দুই. ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত “High-level Dialogue on “Digital Cooperation: Action Today for Future Generations” শীর্ষক সভায়মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অংশগ্রহণ করবেন। এই সভায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবী নিশ্চিতকরণে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
তিন. জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগে ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য “High Level Roundtable on Climate Action” শীর্ষক সভা। এ সভায় অংশগ্রহণ করে Climate Vulnerable Forum (CVF)-এর সভাপতি হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি মোকাবেলায় বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা,জলবায়ূ পরিবর্তনের ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোকে প্রতিশ্রুত তহবিল প্রদান, জলবায়ু শরণার্থীদের পুনর্বাসনের মত বিষয়সমূহ তুলে ধরবেন।
চার. ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে “High-level event on Financing for Development (FFD) in the era of COVID-19 and beyond” শীর্ষক সভা অনুষ্ঠিত হবে। এই সভায় অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোভিড-১৯ এরক্ষতিকর প্রভাব থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের উপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। এ সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা,সরকারি অর্থের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের অর্থায়ন,নর্থ সাউথ ট্রায়াঙ্গুলারকো-অপারেশন এবং অভিবাসী ও রেমিট্যান্স বিষয়ে জোরালো দাবী উত্থাপন করবেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এফএফডি -এর ডিসকাশন গ্রুপের কো-লিড হিসেবে বিভিন্ন সময়ে এসব দাবি তুলে ধরছে।
পাঁচ. ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে “Summit on Biodiversity”শীর্ষক সভা।উক্ত সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জীব বৈচিত্র্যের হুমকির কারণসমূহ এবং এ হুমকি মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাবেন। এছাড়া, তিনি জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত কার্যাবলী উল্লেখ করবেন এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধের মাধ্যমে জীব বৈচিত্র্য রক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করবেন।
ছয়. ০১ অক্টোবর ২০২০ তারিখে “High-level meeting to mark the 25th anniversary of the Fourth World Conference on Women and the adoption of the Beijing Declaration and Platform for action (Beijing +25)”শীর্ষক সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অংশগ্রহণ করবেন।এই সভার মুল প্রতিপাদ্য হলোঃ ‘Accelerating the realization of gender equality and the empowerment of all women and girls’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ণ ও নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসনে আমাদের অভাবনীয় সাফল্যের বিষয়টি এই সভায় তুলেধরবেন। একইসাথে এ বিষয়ে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অংশীদারিত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করে যাওয়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করবেন।
০৭। এছাড়া, বাংলাদেশপ্রতিনিধিদলেরসদস্য হিসেবে আমি “High-level plenary meeting to commemorate and promote the International Day for the Total Elimination of Nuclear Weapons”শীর্ষক সভাসহকয়েকটি সভায় অংশগ্রহণ করবো। ইতোমধ্যে আমি স্বল্পোন্নত দেশ সমূহের মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় অংশগ্রহণ করেছি। এছাড়াও, মাননীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীওকয়েকটি সভায় অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
০৮। এবারের অধিবেশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একদিকে যেমন কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত নানাবিধ পদক্ষেপের বিষয়ে আলোকপাত করতে পারবেন, তেমনি এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সাফল্য ও অগ্রগতি, নারী উন্নয়ন ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অনুসরনীয় কার্যক্রম, দারিদ্র্য বিমোচনে গৃহীত নানাবিধ পদক্ষেপ, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ দমন ও মাদকের বিস্তার রোধ, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, গণতন্ত্র ও সুশাসনের ধারা অব্যাহত রাখা ও সর্বোপরি বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের অবদানের বিষয়ে বিশ্ববাসীকে অবহিত করতে পারবেন। । এছাড়াও, রোহিঙ্গা সমস্যা ও এর সমাধানের বিষয়ে বিশ্ববাসীর সার্বিক অবস্থান ও কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য এ বিষয়টি উত্থাপন করতে পারেন। কোভিড-১৯-এর প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিতব্য এই সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ এই ক্রান্তিকালে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব প্রসারে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।