মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য প্রস্তুতকৃত বক্তব্যের খসড়া
কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তন, জাতীয় জাদুঘর
৬ ডিসেম্বর ২০১৯
আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি বিচারপতি জনাব শামসুদ্দিন চৌধুরী,
বিশেষ অতিথি বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার শ্রীমতী রীভা গাঙ্গুলি দাশ,
সম্মানিত আলোচক বৃন্দ,
মুক্তিযোদ্ধা প্রাক্তন ডেপুটি স্পিকার কর্নেল শওকত আলী
মানবাধিকার নেত্রী আরমা দত্ত এমপি,
বৃটিশ মানবাধিকার নেতা জুলিয়ান ফ্রান্সিস,
আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা,
সম্মানিত সাংসদবৃন্দ,
সম্মানিত অতিথিবৃন্দ, ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ,
শুভ সকাল।
অনুষ্ঠানের শুরুতে শ্রদ্ধা জানায় ৩০ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধাকে যারা দেশের জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন এবং দুই লক্ষ মা বোনদের যারা তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন। সেই সাথে আমি আবেদন করব আজকের অনুষ্ঠানে যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা আছেন তারা যদি একটু উঠে দাঁড়ান; তাদের সম্মান দিতে পারলে আমরা খুশি হবো। আমরা আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
আজকের এই দিনটি নিঃসন্দেহে একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য একটি অত্যন্ত স্মরণীয় ও ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আজকের এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমাকে আমন্ত্রণ করায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, লেখক ও সাংবাদিক জনাব শাহরিয়ার কবিরকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ডিসেম্বর মাস বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমগ্র জাতি, ধর্ম, ভাষা নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকস্তানের ঘাতকবাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ।
সম্মানিত সুধী,
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত সরকার এবং ভারতীয় জনগণের বহুমাত্রিক অবদানের বিস্তারিত আলোচনা ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা দুই বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে একই সঙ্গে রক্ত ঝরিয়েছি । মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক, উকিল-মোক্তার, বুদ্ধিজীবী, যুবক-যুবতী, সকল শ্রেণির জনগণ এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। দেশের তিনকোটি লোক বাড়িছাড়া হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারত বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং তাঁদের অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে তা তুলনাহীন । বাংলাদেশের বিপৎকালীন সময়ে ভারতের জনগণের সহানুভূতি এবং আতিথেয়তা এ দেশের মানুষ সবসময়েই স্মরণ করবে । এছাড়াও, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠনে ভারত সরকারের অপরিসীম অবদান কখনোই ভোলার নয় । বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় ১৭,০০০ সদস্য শহিদ হয়েছেন এবং আরো অনেকে আহত হয়েছেন । আজ শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর সেসব শহিদ দের এবং ভারতীয় জনগনের অপরিসীম অবদানের কথা।
ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ,
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরুপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ ভারতীয় অনেক সেনা পরিবারের সদস্যদের সম্মাননা প্রদান করেছেন । এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মাননীয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ১২ ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যের পরিবারের হাতে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা তুলে দেন । অবশিষ্ট ১,৫৮২ জন শহিদ ভারতীয় সেনা সদস্যদেরকেও সম্মাননা দেওয়ার প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ৩৮০ জন শহীদ ভারতীয় সেনা সদস্যের জন্য সম্মাননা স্মারক প্রস্তুত করেছে, যা শীঘ্রই ভারতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
প্রিয় বন্ধুগণ,
আজ আমরা বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতির ৪৮-তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে একত্রিত হয়েছি। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের শুরু থেকেই উভয় দেশ অভিন্ন ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বন্ধনে আবদ্ধ । জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্কের শক্তিশালী বীজ বপন করেন । এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব ও দিক নির্দেশনায় এ দু’দেশের বন্ধুত্ব, পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা ও বোঝাপড়া বর্তমানে অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে দৃঢ়তর । যার ফলে পারস্পরিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হচ্ছে । বিগত এক দশকে আমাদের উভয় দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এক অনন্য উচ্চতায় আসীন হয়েছে; যাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘সোনালী অধ্যায়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এ বছরের অক্টোবর মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নয়া দিল্লী সফর করেন । এ ছাড়া নভেম্বর মাসের ২২ তারিখে ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ভারত সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কলকাতায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গোলাপী বলে অনুষ্ঠিত প্রথম দিন-রাত্রি ক্রিকেট ম্যাচের উদ্বোধন করেন। আগামী বছর মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে । তাছাড়া ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এবং শ্রীমতি সোনিয়া গান্ধীও বাংলাদেশ সফর করবেন। আমাদের দু’দেশের সরকার প্রধানদের এই অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বাংলাদেশ এবং ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নিঃসন্দেহে আরো অনেক বেশি শক্তিশালী করেছে, এবং আমরা আশাবাদী যে আগামীতে আমাদের এ সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে নিবিড়তর হবে। সেই সাথে আমাদের দেশের জনগণের প্রত্যাশা যে, বন্ধুপ্রতীম ভারত এমন কিছু করবে না যাতে উভয় দেশের জনগণের মধ্যে দুশ্চিন্তা বা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পরস্পর বন্ধুত্বের মাধ্যমেই বাংলাদেশ ভারত এগিয়ে যাবে, উভয় দেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে।
পরিশেষে আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির সভাপতি এবং সদস্যবৃন্দকে প্রতি বছর এই দিনটিকে যথাযথভাবে উদযাপনের মহৎ উদ্যোগের জন্য।
আমি আশা করি, আগামী বছর একই দিনে আমরা আবারো একত্রিত হবো বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্ব উদযাপনের লক্ষ্যে।
সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু
বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব অটুট থাকুক